ডেস্ক রিপোর্ট:
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের যুগ চলছে এখন। বাংলাদেশে এই যুগ বেশ আগে শুরু হলেও প্রসার ঘটেছে গত এক দশকে। দেশে বহুল ব্যবহৃত সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের মধ্যে রয়েছে ফেসবুক, টুইটার, টিকটক, হোয়াটসঅ্যাপ, ইনস্টাগ্রাম, স্ন্যাপচ্যাট, লিংকডইন, টেলিগ্রাম, ইমো, ইউটিউব ইত্যাদি।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম যেমন অনেক কিছুকে সহজ করেছে তেমনি নেতিবাচক প্রভাবও তৈরি করছে সমাজে। এখন অনলাইনে প্রতারণার ধরন বদলাচ্ছে। সম্প্রতি দেশের শীর্ষ ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান ইভ্যালিসহ বেশ কয়েকটি ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের প্রতারণার খবর সামনে এসেছে। এছাড়া বিচ্ছিন্নভাবে দেশের নানা অঞ্চলে অনলাইন প্রতারণার খবরও পাওয়া যাচ্ছে। আর এর সিংহভাগ ঘটছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম কেন্দ্রীক।
এই ধরনের প্রতারণা বন্ধ করতে কঠোর হয়েছে সরকার। তবে তা পুরোপুরি বন্ধ করতে পারেনি। ফলে সাধারণ মানুষের পক্ষে এখন বোঝা কঠিন হয়ে পড়েছে যে কারা প্রতারক এবং কারা প্রতারক নন।
চাকরি দেওয়ার নামে প্রতারণা
গত বছর মারোয়াড়ি ব্যবসায়ী সেজে অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তাদের বিপুল পরিমাণ টাকা হাতিয়ে নেওয়ার ঘটনা ঘটেছে। প্রতারিতরা লজ্জায় নিজেদের নামও প্রকাশ করছেন না। ওই প্রতারক চক্র ঢাকার অভিজাত এলাকায় অফিস খুলে বিদেশি বিনিয়োগের প্রতিষ্ঠান বলে নিজেদের ওয়েব সাইটে মোটা বেতনে অবসরপ্রাপ্ত সরকারি চাকরিজীবীদের নিয়োগের বিজ্ঞপ্তি দেয়।
যারা যোগাযোগ করেন তাদের সঙ্গে মাড়োয়ারি ব্যবসায়ী সেজে প্রতারক চক্রের সদস্যরা কথা বলেন। তাদের অফিস, গাড়ি ও হাবভাব দেখে ফেঁসে যান চাকরিপ্রার্থী অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তারা। তাদের বেতন ধরা হয় দেড় থেকে দুই লাখ টাকা, পদও দেওয়া হয় বড়। এরপর বিদেশে বিনিয়োগের টাকা আটকে গেছে বলে কথিত প্রমাণও দেখায়। সাময়িক সাপোর্টের নামে কর্মকর্তাদের কাছ থেকে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেয় তারা।
বিনিয়োগের নামে প্রতারণা
একইভাবে গত বছর ঢাকায় বিনিয়োগের নামে ফেসবুকে কয়েকজন ব্যক্তির সঙ্গে যোগাযোগ করেন আফ্রিকা ও বাংলাদেশি একটি প্রতারক চক্রের সদস্যরা। যারা যোগাযোগ করেন তাদের প্রত্যেককে বলা হয়, তারাই হবেন তাদের ব্যবসার বাংলাদেশি এজেন্ট। আবাসন ও কৃষি খাতে তারা বিনিয়োগ করবেন। তাদের জমি দেখতেও বলা হয়। একজন বাংলাদেশে এসে প্রজেক্টের জন্য কোটি কোটি টাকা দামের জমিও দেখে যান। এভাবে আস্থা অর্জন করে বিদেশ থেকে অর্থ পাঠানোর আগে প্রাথমিক কাজের জন্য তাদের স্থানীয় এজেন্টকে ধার হিসেবে টাকা দিতে বলেন। এইভাবে তারা কয়েক কোটি টাকা হাতিয়ে নেন।
এই চক্রের একজন ভুক্তভোগী মিজানুর রহমান। তিনি জানান, “পাঁচ লাখ টাকা নেওয়ার পর বুঝতে পারি তারা প্রতারক। থানায় অভিযোগ করার পর চক্রের সদস্য একজন আফ্রিকান নাগরিককে গ্রেপ্তারও করা হয়। তখন আমি বুঝতে পারি তারা এই দেশে থেকেই আমার সঙ্গে সব যোগাযোগ করে। কিন্তু আমার টাকা উদ্ধার করতে পারিনি। কারণ টাকা তারা আগেই সরিয়ে ফেলেছে।”
অন্যদিকে “নুর কিচেন” নামে একটি প্রতারক চক্র ফেসবুকে বিনিয়োগ প্রতারণার ফাঁদ পেতেছে। তারা ঢাকা মেডিকেলে খাবার সরবরাহের কাজ পেয়েছে বলে আকর্ষণীয় মুনাফার লোভ দেখিয়ে বিনিয়োগ করার জন্য প্রলোভিত করে। কমপক্ষে তিন লাখ টাকা বিনিয়োগ করতে হবে। তারা আদৌ ওই ধরনের কোনো কাজ পায়নি। আর প্রতিষ্ঠানটিও বাস্তবে অস্তিত্বহীন।
গিফট পাঠানোর নামে প্রতারণা
ফেসবুকে বন্ধুত্ব করে দামি গিফট পাঠানোর নামে টাকা হতিয়ে নেওয়ার প্রতারণা পুরোনো। তারপরও মানুষ ওই প্রতারকদের খপ্পরে পড়ছেন। উত্তরাধিকার সূত্রে লাখ লাখ ডলারের মালিক হয়ে সেই টাকা বাংলাদেশে পাঠানোর প্রতারণার ফাঁদ পাতা হচ্ছে প্রতিদিনই। কেউ পা দিলেই ধরা।
অনলাইনে জুয়ার বিজ্ঞাপন
সম্প্রতি ফেসবুক ও ইউটিউবার প্রত্যয় হিরনকে পুলিশ গ্রেপ্তার করেছে ফেসবুক ও ইউটিউবে কনটেন্ট তৈরির আড়ালে অনলাইনে জুয়ার বিজ্ঞাপন প্রচারের অভিযোগে৷ গত তিন বছর ধরে ভারতীয় এক এজেন্টের সঙ্গে জুয়ার বিজ্ঞাপন প্রচারে চুক্তি ছিল প্রত্যয় হিরনের৷ নিষিদ্ধ জুয়ার ব্যবসা প্রচারে একেকটি বিজ্ঞাপন প্রচারের জন্য প্রত্যয় নিতেন প্রায় লাখ টাকা৷
কৌশল বদলাচ্ছে প্রতারকরা
ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগের উপকমিশনার মশিউর রহমান জানান, এখন ছোট থেকে বড় সব ধরনের প্রতারণাই হচ্ছে অনলাইনে। গৃহশিক্ষক দেওয়া থেকে শুরু করে পাত্র-পাত্রী সবখানেই অনলাইন প্রতারণা। আর প্রতারকরা সময়ের সঙ্গে কৌশলও বদলাচ্ছে।
অনলাইনে অনৈতিক সম্পর্ক
ডিভোসর্ড প্রবাসী পাত্রী পরিচয়ে প্রতারক চক্রের শিকার হচ্ছেন অনেকে। কেউ আবার অনলাইনে অনৈতিক সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ে ফেঁসে যাচ্ছেন। তিনি জানান, “ঢাকায় উচ্চবিত্তরাও এর শিকার হচ্ছেন। এমন কয়েকজন অভিযোগ করেছেন যারা টাকা তো খুইয়েছেনই এখন মানসম্মান রক্ষার চিন্তায় আছেন। তারা লিখিত অভিযোগও করতে চান না। শুধু প্রতারক চক্রকে থামাকে পারলেই যেন তারা বেঁচে যান।”
ফেসবুকে বিদেশি নারীর ছবি ব্যবহার করেও চলছে প্রতারণা। তাদের কেউ ইউএস আর্মি বা নেভির সদস্য বলেও পরিচয় দেন। সেই ধরনের ছবিও থাকে। ফেসবুকে বন্ধুত্ব তৈরি করে। তারপর নানা কৌশলে টাকা হাতিয়ে নেয়। কেউ আবার আছেন বিদেশি কথিত বিনিয়োগকারী।
অনলাইনে মাদকের বিরাট বাজার
অনলাইনে এখন মাদকের বিরাট বাজার গড়ে উঠেছে। এর সঙ্গে প্রধানত তরুণরা যুক্ত। মাদকসেবী ও ব্যবসায়ী সবাই তরুণ। টিকটক হৃদয়ের কথা সবাই এখন জানেন। তিনি অনলাইনে টিকটক তারকা বানানোর লোভ দেখিয়ে ভারতে অনেক নারীকে পাচার করেছেন। টিকটক হৃদয় এখন ভারতের কারাগারে আটক আছেন।
উপ-কমিশনার মশিউর রহমান বলেন, “তারপরও টিকটক প্রতারণা থামছে না। প্রতারক চক্রের ফাঁদে পা দিচ্ছেন অনেকেই।”
ইমো প্রতারণা
সম্প্রতি ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা দপ্তরের সাইবার অ্যান্ড স্পেশাল ক্রাইম টিম ইমো প্রতারণার একটি চক্রের চার সদস্যকে আটক করেছে। তারা মেয়ে সেজে নারী কন্ঠে প্রতারণা করে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন।
সুন্দর চেহারার ছবি দিয়ে কথিত নারীর আইডি থেকে মেসেজ দেওয়া হতো প্রবাসীদের। এরপর শুরু কথোপকথন ও ছবি আদান-প্রদান। সুন্দর ছবি ও মধুর কন্ঠের অন্তরঙ্গ আলাপচারিতার সহজেই প্রেমের সম্পর্কে জড়িয়ে পড়তেন প্রবাসীরা। পরে ভিডিও কলের প্রলোভনে কৌশলে প্রবাসীদের ইমো আইডি নেওয়া হতো নিয়ন্ত্রণে। পরে ইমো নম্বর পরিবর্তন করে অ্যাকাউন্টের প্রাইভেসি হিস্টোরিতে গিয়ে পরিবার ও আত্মীয় স্বজনদের নম্বর সংগ্রহ করে নানা বাহানায় হাতিয়ে নিতেন টাকা।
সীমাহীন প্রতারণা
ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা দপ্তরের সাইবার অ্যান্ড স্পেশাল ক্রাইম বিভাগের অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার সাইফুর রহমান আজাদ বলেন, “এখন সব কিছুই প্রকাশ্য। তাই সীমাহীন প্রতারণা চলছে। বিকাশ ও ইমো হ্যাকিং এখন অনলাইন প্রতারণার শীর্ষে রয়েছে।
এছাড়া অনলাইনে বিভিন্ন সরকারি কাজ পাইয়ে দেওয়া, কাজের অর্ডার করিয়ে দেওয়া, চাকরি দেওয়াসহ নানা প্রতারণা চলছে। অধিকাংশ অনলাইন প্রতারণাই হয় বেশি লাভ বা বেশি কিছু পাওয়ার লোভ দেখিয়ে।
প্রতারকরা অনেক স্মার্ট
আগে সাইবার ক্রাইম ও অনলাইন প্রতারণা নিয়ে মানুষ তেমন অভিযোগ করতো না। এখন প্রচুর অভিযোগ। তবে মামলা কম। মানুষ ফোনে জানাচ্ছে, এসএমএস দিচ্ছে, মৌখিকভাবে অভিযোগ করে সমাধান চান। সেক্ষেত্রে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া যায় না। এছাড়া প্রতারকরাও স্মার্ট হওয়ায় তাদের ধরাও কঠিন। সাইবার ক্রাইম রোধে গোয়েন্দারা নানা ধরনের প্রযুক্তি ও ডিভাইস ব্যবহার করছেন। তবে প্রতারকরা নতুন যত প্রযুক্তি বাজারে আসে সবগুলোই ব্যবহার করতে পারেন।
সচেতনতার বিকল্প নেই
সাইবার ক্রাইম নিয়ে কাজ করেন আইটি এক্সপার্ট তানভীর হাসান জোহা। তিনি বলেন, “অনলাইন প্রতারণা থেকে বাঁচতে হলে আমাদের সতর্ক হতে হবে। লোভ সামলাতে হবে। অনলাইনে কারো সঙ্গে পরিচয় হলে সাবধান থাকতে হবে।”
তিনি বলেন, “পুলিশের সাইবার ক্রাইম ইউনিট অনেক আধুনিক হয়েছে। কিন্তু প্রতারকরা আরও এগিয়ে। প্রতারিত হওয়ার আগে কোনো প্রস্তাব পেলে সে বিষয়েও পুলিশের সাহায্য নেওয়া যায়। এটি করতে হবে।”
পুলিশের উপকমিশনার মশিউর রহমান বলেন, “সচেতন হলে আমরা অনলাইনে সম্মানহানি, মানহানি ও অর্থ খোয়ানো থেকে বাঁচতে পারি।”