ডেস্ক রিপোর্ট:
নারায়ণগঞ্জ শহরের বহুল আলোচিত হকার ইস্যুর পর থেকে আলোচনায় নিয়াজুল ইসলাম খান যাঁর নামটিও উচ্চারিত হয়নি ২০০৮ সালের ডিসেম্বরে সংসদ নির্বাচনের পর থেকে। প্রায় ১৪ বছর রাজনীতিতে যেমন নিস্ক্রিয় ছিলেন তেমনি ছিলেন আলোচনারও বাইরে। ২০১৮ সালের ১৬ জানুয়ারী হকার ইস্যুতের কোমর থেকে পিস্তল বের করার পর থেকে তিনি এখন আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু যা সবশেষ গিয়ে ঠেকে সিটি করপোরেশনের ১২নং ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতি পদে নির্বাচিত হওয়ার মাধ্যমে। নিয়াজুলের সামনের সঙ্গে জুড়ে যায় ‘অস্ত্রধারী’ খেতাব। যদিও অস্ত্রটি লাইসেন্সকৃত। সভাপতি হওয়ার পর এ নিয়ে নারায়ণগঞ্জ মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি আনোয়ার হোসেন খোদ তার বিরুদ্ধে ‘সন্ত্রাসী’ মন্তব্য করেছেন। যদিও টানা তিনবারের ক্ষমতায় চলাকালে নিয়াজুলের বিরুদ্ধে কোন থানায় জিডি বা মামলা হয়নি। ‘হকার ইস্যুর দিন তিনি অস্ত্র বের করেছিলেন হত্যার উদ্দেশ্যে’ সেদিনের ঘটনায় আক্রান্ত সিটি করপোরেশনের মেয়র সেলিনা হায়াৎ আইভী এ অভিযোগ করলেও নিয়াজুল বলছেন ভিন্ন কথা। সেদিন আসলে কি ঘটেছিল, নিয়াজুল কি আসলেই মেয়র আইভীকে খুন করতে গিয়েছিল? নিউজ নারায়ণগঞ্জের প্রতিবেদকের সঙ্গে আলাপকালে তিনি জানিয়েছেন তার প্রতিক্রিয়া, ঘটনার বিবরণ ও সামগ্রিক চিত্র।
সেই ঘটনা
২০১৮ সালের ১৬ জানুয়ারী হকার উচ্ছেদ নিয়ে শহরে হকারদের সঙ্গে মেয়র আইভী সমর্থকদের সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। সেদিন প্রকাশ্যে পিস্তল উঁচিয়ে ধরেন নিয়াজুল। পরে তাকের মারধর ও দুই পক্ষের সংঘর্ষে আইভী, নিয়াজুল সহ আহত হয় অর্ধশত। খোয়া যায় নিয়াজুলের লাইসেন্স করা অস্ত্র। পরে সেটা উদ্ধারও হয় পরিত্যাক্ত অবস্থায়। একই দিন শাহ নিজাম অস্ত্র হাতে নিয়ে গুলি করেছিল। প্রকাশ্য কয়েক রাউন্ড গুলি ছুড়েছিল। ২২ মাস ১৮ দিন পর ২০১৯ সালের ৪ ডিসেম্বর উচ্চ আদালতের নির্দেশে সদর মডেল থানায় দেয়া অভিযোগটি মামলা হিসেবে রেকর্ড করা হয়। মামলায় ৯ জনকে বিবাদী করা হয়। তারা হলেন ঘটনার সময়ে অস্ত্র প্রদর্শনকারী নিয়াজুল ইসলাম খান ও মহানগর আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদক শাহ নিজাম, সাংগঠনিক সম্পাদক জাকিরুল আলম হেলাল, নগর যুবলীগের সভাপতি শাহাদাৎ হোসেন সাজনু, জেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগের সভাপতি জুয়েল হোসেন, স্বেচ্ছাসেবক লীগ নেতা জানে আলম বিপ্লব, জেলা ছাত্রলীগের সাবেক প্রয়াত সাধারণ সম্পাদক মিজানুর রহমান সুজন, যুবলীগকর্মী নাসির উদ্দিন, যুবলীগ নেতা চঞ্চল মাহমুদ। মামলাটি শুরুতে সদর মডেল থানা তদন্ত শুরু করেন। পরে পিবিআই এর পরিদর্শক আতাউর রহমান তদন্ত শুরু করে গত ডিসেম্বরে আদালতে চার্জশীট দাখিল করেন। এছাড়া শাহ নিজাম ও নিয়াজুল সহ ১২ জনকে অভিযুক্ত করা হয়েছে। এ তালিকাতে আছেন হকার নেতা রহিম মুন্সী, আসাদুল ইসলাম, সায়মন, ইকবাল, মাসদ পাটোয়ারী, তোফাজ্জল, পলাশ, মহসিন বেপারী, সালাউদ্দিন ও সাদেকুল।
যা বলেছেন নিয়াজুল
সেদিনের ঘটনা বর্ণনা করতে গিয়ে নিয়াজুল ইসলাম খান বলেন, ‘‘শিবু মার্কেটের রাণী মা প্লাজায় আমার একটি মার্কেট আছে। সেখানে আমি প্রতিদিন দুপুরের পর যেতাম এবং কয়েক ঘণ্টা সেখানে অবস্থান করে আসরের নামাজ নারায়ণগঞ্জ ক্লাবে পড়তাম। ২০১৮ সালের ১৬ জানুয়ারী গাড়ি নিয়ে নারায়ণগঞ্জ রাইফেল ক্লাবে আসা মাত্রই দেখি সেখানে প্রচুর মানুষের ভিড়। তাই গাড়ি রেখে পায়ে হেঁটেই ক্লাবের দিকে যেতে লাগলাম। এমন সময় দেখি মেয়র আইভী প্রচুর মানুষ নিয়ে চাষাঢ়ার দিকে আসছে। এতো মানুষ দেখে আমি ফুটপাত দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিলাম পানোরোমা প্লাজায় সামনে যাওয়া মাত্রই কিছু ছেলে আমার সাথে ধাক্কাধাক্কি করা শুরু করে। যখন আমার সাথে এমনটা করা হচ্ছিল তখন জেলা যুবলীগের কাদির ভাই, আওয়ামী লীগের জাহাঙ্গীর ভাই, সুফিয়ান ছিলেন। আমি তখন কাদির ভাইকে বলেছিলাম, কাদির ভাই আমার সাথে কেনো এমন করা হচ্ছে? আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না। তখন কাদির ভাই, সুফিয়ান তাদেরকে সরিয়ে দিলো। তারা চাইলে আমাকে সেফ করতে পারতেন। আমাকে তো তারা ভালো করেই চিনেন। কিন্তু আমাকে আবার কয়েকবার ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেওয়া হলো। আমি ওদের সাথে না পেরে এক পর্যায়ে তাদের ভয় দেখাতে আমার লাইসেন্সযুক্ত অস্ত্র বের করতে বাধ্য হই। আমাকে সেদিন হত্যা করার চেষ্টা করা হয়েছিল। কিন্তু কিছু সাংবাদিক প্রচার করেছেন আমি আমার মেয়র আইভিকে মারতে গিয়েছি। আসলে সুন্দর এই পৃথিবী মায়ের জন্য। মায়ের পেটে আমরা জন্ম না নিলে এই পৃথিবীর সৌন্দর্য অনুভব করতে পারতাম না। মেয়র একজন মায়ের চরিত্রের। আমি কেনো তাকে হত্যা করতে যাবো? আর সবচেয়ে বড় কথা, মেয়র ব্লেইম দিয়েছেন শামীম ওসমান নাকি আমাকে নাকি তাকে হত্যা করতে পাঠিয়েছেন। কিন্তু শামীম ওসমান এমন মানুষ না। তাদের পুরো পরিবার থেকে আমি রাজনৈতিক অনেক জ্ঞান লাভ করেছি। শামীম ভাই আজ পর্যন্ত এমন কিছু শিখিয়ে দেননি যে বেয়াদবি করতে হবে, কটু কথা বলতে হবে। দলের মধ্যে এদিক ওদিক থাকবেই। আমি যদি কোনো অন্যায় করে থাকি সেজন্য আওয়ামী লীগের কর্মীরা আমাকে মেরেছে তাতে আমার কোনো কষ্ট নেই কিন্তু আমার কষ্ট ওইখানেই যারা আমার ভাইকে মেরেছে, রাজপথে জুলুম করেছে তাদেরকেই সামনে রেখে মেয়রের উপস্থিতিতে আমাকে হত্যাচেষ্টা করা হয়েছে। আমি হয়তো জীবনে কোনো ভালো কাজ করেছি সেজন্য হয়তো আল্লাহ সেদিন আমাকে বাঁচিয়ে দিয়েছেন। আর আমার লাইসেন্স করা অস্ত্রটি তারা ছিনিয়ে নিয়েছিল। এখন এটি কোর্টে আছে। কোর্ট যদি মনে করে আমাকে দেওয়া ঠিক হবে দিবে, দেওয়া ঠিক না মনে হলে দিবে না। তাতে আমার কোনো সমস্যা নেই। আমিতো অস্ত্র ছাড়াই ৫ বছর চলাচল করছি।’
নিয়াজুল বলেন, আমার উপর যারা হামলা করেছেন তারা দলের কেউ না। তারা আমার দলকে সামনে রেখে আওয়ামী জামায়াত যারা আমাদের অপছন্দ করেন তারা আমার উপর হামলা করেছে। এটিই আমার দুর্ভাগ্য। কয়েকজন আমার উপর হামলা করতে উস্কানি দিয়েছিল। আমি দেখেছিলাম অ্যাডভোকেট মাসুম ভাই মেয়রকে কিছু বলছেন। আমি এটা নিজের চোখেই দেখেছি। এখন হয়তো সে এটা অস্বীকার করবেন। আমাদের মেয়রও অস্বীকার করবেন। ওই উস্কানির পরই আমার উপর হামলা করা হয়। আমি কল্পনাও করতে পারি নাই আমার মেয়রকে সামনে রেখে আমার উপর হামলা করা হবে। তারা ভেবেছে আমাকে সরিয়ে দিলে হয়তো তাদের কোনো স্বার্থ হাসিল হবে। আমি তো কিছু বলে নি। আমি প্রতিদিনের মতো ওইখান দিয়ে যাচ্ছিলাম।
তার সঙ্গে অস্ত্র রাখার বিষয়ে তিনি বলেন, জীবনের নিরাপত্তার জন্য আমি সবসময় অস্ত্র রাখতাম। ১৯৯৫ সালে বিএনপির সন্ত্রাসীরা আমাকে মারার জন্য গুলি করেছিল। আমার কাছে তখন কোনো অস্ত্র ছিল না। আমি মরে গেছি ভেবে আমাকে ফেলে রেখে চলে গিয়েছিল। পরে আমার বন্ধু আর আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা আমাকে উদ্ধার করে হলি ফ্যামিলি হাসপাতালে ভর্তি করে। তখন ৪ দিন নাসিম ভাই (জাতীয় পার্টির প্রয়াত এমপি) হাসপাতালে ছিলেন। সেলিম ভাই আমাকে আর্থিকভাবে সাহায্য করেছিলেন। শামীম ভাই তখন দেশের বাহিরে ছিলেন।
১২ নং ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতি হওয়ার আগে কখনো দলীয় পদে ছিল কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বাহাউদ্দিন নাসিম ভাইকে ১৯৯৪ সালে স্বেচ্ছাসেবক লীগের সভাপতির দায়িত্ব দেওয়া হয়। তখন বাংলাদেশের প্রথম কমিটি করেন আমাদের নারায়ণগঞ্জে। তখন নারায়ণগঞ্জ জেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগের আহবায়ক কমিটি গঠন করা হয়। এই কমিটির আহবায়ক ছিলেন মাহাতাব উদ্দিন লাল। আর ওই কমিটির সদস্য সচিব ছিলাম আমি।
১২নং ওয়ার্ড নিয়ে পরিকল্পনার কথা বলতে গিয়ে তিনি বলেন, আমি ছোটবেলা থেকেই নারায়ণগঞ্জ নিয়ে কাজ করছি। যখন থেকে বুঝতে শুরু করেছি তখন থেকেই আমি আওয়ামী লীগের সঙ্গে জড়িত। আমি এখন যেহেতু ১২নং ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতি হয়েছি। আমি চেষ্টা করবো ২৪ ঘণ্টা আমার ওয়ার্ডে কাজ করার। আমি গরীব, মেহনতি মানুষের কাজ করার জন্য সদা প্রস্তুত রয়েছি।