নারায়াণগঞ্জ

শামসুজ্জোহার মৃত্যুবাষির্কী আজ



সময়টা ১৯৭১ সালের ১৭ ডিসেম্বর। পূর্ব বাংলায় স্বাধীনতার উলুধ্বনি তখন চারদিকে ছড়িয়ে পড়েছে। পাক বাহিনী আত্মসমর্পন করে বিদায় নিচ্ছে নতুন বাংলাদেশ থেকে। মুজিবনগর সরকার গঠন হলেও সেই সময় জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, তাঁর স্ত্রী ফজিলাতুন্নেসা, কন্যা শেখ হাসিনা পাক সেনাদের হাতে আটক ছিলেন। ঠিক সেই সময়ে মুজিবনগর সরকারের প্রতিনিধি হিসেবে প্রথম বেতার ভাষণ প্রদান করেন এবং দেশের সর্বোচ্চ আদালতে জাতীয় পতাকা উত্তোলন করেন একেএম শামসুজ্জোহা।


এ কে এম শামসুজ্জোহা ছিলেন আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য, গণপরিষদের সদস্য ও সংসদ সদস্য। তিনি ভাষা সৈনিক, মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক, বঙ্গবন্ধুর সহচর হিসেবেই পরিচিত। তিনি এদেশের অন্যতম ঐহিত্যবাহী ওসমান পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা মরহুম খান সাহেব ওসমান আলীও ছিলেন একজন ভাষা সৈনিক, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য এবং সাবেক এমএনএ।

২০ ফেব্রুয়ারি এ কে এম শামসুজ্জোহার মৃত্যুবার্ষিকী। ১৯৮৭ সালের এই দিনে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। মহান মুক্তিযুদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখায় তিনি ২০১২ সালে স্বাধীনতা পদক (মরণোত্তর) লাভ করেন। তিনি ১৯৫০ সালে নাগিনা জোহাকে বিয়ে করেন, তিনি তিনটি ছেলে সন্তান জননী হয়েছেন এই নারী। তাঁর সন্তানরা সংসদীয় নির্বাচনে জয়লাভ করে ও সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছে। নাগিনা জোহাও ভাষা আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন।



একেএম শামসুজ্জোহার বড় ছেলে প্রয়াত একেএম নাসিম ওসমান। যে কিনা বাংলাদেশ জাতীয় পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য ও সাবেক সংসদ সদস্য। তার নির্বাচনী এলাকা ছিলো নারায়ণগঞ্জ-৫। নাসিম ওসমান প্রথমে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ দলীয় রাজনীতির সাথে জড়িত ছিলেন। পরবর্তীতে তিনি বাংলাদেশ জাতীয় পার্টির রাজনৈতিক আদর্শে বিশ্বাসী হয়ে পড়েন। তিনি ৪ বার বাংলাদেশ জাতীয় পার্টির হয়ে বাংলাদেশের জাতীয় সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন, যথাক্রমে ১৯৮৬, ১৯৮৮, ২০০৮ ও ২০১৪ সালে।

একেএম শামসুজ্জোহার মেজো ছেলে এ কে এম সেলিম ওসমান। তিনি জাতীয় পার্টির রাজনীতি করেন। ২০১৪ সালের ২৬ জুন নারায়ণগঞ্জ-৫ আসনের উপনির্বাচনে সেলিম ওসমান জাতীয় পার্টির লাঙ্গল প্রতীকে নির্বাচন করে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। সে বিকেএমইএ ও নারায়ণগঞ্জ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাষ্ট্রি’র সভাপতি দায়িত্ব পালন করেছেন। বর্তমানে শুধুমাত্র বিকেএমইএ সভাপতি ও সংসদ সদস্যের দায়িত্বে আছেন শামসুজ্জোহার মেজো ছেলে সেলিম ওসমান।

একেএম শামসুজ্জোহার ছোট ছেলে একেএম শামীম ওসমান। সে ১৯৯৬ সালে ৭ম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। বর্তমানে তাকে বাংলাদেশের সর্বোচ্চ প্রভাবশালী এমপিদের মধ্যে বিবেচনা করা হয়। শামীম ওসমান নারায়ণগঞ্জ -৪ আসন থেকে সপ্তম, দশম, একাদশ ও দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিজয়ী সংসদ সদস্য। বর্তমানে এমপি শামীম ওসমান জাতীয় সংসদে রেলপথ মন্ত্রণালয়, শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় ও শিল্প মন্ত্রণালয়ের সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটির সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।


একেএম শামসুজ্জোহার পৈতৃক নিবাস নারায়ণগঞ্জের বায়তুল আমান ভবন। আজও কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে যেখানে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠার বীজ বপন করা হয়েছিল। মহান ভাষা আন্দোলনের সময় এই বায়তুল আমান ভবনে তৎকালীন পুলিশ প্রবেশ করে ওসমান পরিবারের সদস্যদের উপর অকথ্য নির্যাতন চালানোর অভিযোগ খুঁজে পাওয়া গেছে। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অসমাপ্ত আত্মজীবনীতেও উঠে এসেছে ভাষা আন্দোলনে এই বায়তুল আমান ভবন ও ওসমান পরিবারের ত্যাগের কথা। মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় ভারতের শরনার্থী শিবিরে শামসুজ্জোহা ‌ত্রাণবন্ধু নামে পরিচিত ছিলেন।

প্রয়াত এই জননেতা সর্বপ্রথম হাইকোর্টে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করেন এবং বাংলাদেশ বেতারের মাধ্যমে বিজয়ের বার্তা প্রচার করে। পাক সেনাদের হাতে আটক বঙ্গবন্ধু পরিবারকে মুক্ত করতে গিয়ে পাক সেনা কর্তৃক গুলিবিদ্ধ হন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নারায়ণগঞ্জের একটি সুধী সমাবেশে সেই ঘটনাটি নিজ মুখে বর্ণনা করেছিলেন, এবং মহান জাতীয় সংসদেও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এই ঐতিহ্যবাহী ওসমান পরিবারের ত্যাগ-তীতিক্ষার কথা স্মরণ করে বক্তব্য দিয়ে নারায়ণগঞ্জবাসীকে গর্বিত করেছিলেন।

পরিবার সূত্রে জানা যায়, মঙ্গলবার (২০ ফেব্রুয়ারি) একেএম শামসুজ্জোহার ৩৭তম মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে দোয়া মাহফিল এর আয়োজন করা হয়। এছাড়াও দিনব্যাপী পবিত্র কোরআন খানি, কবরে পুষ্পস্তবক অর্পণ ও জিয়ারতের পাশাপাশি মরহুমের পরিবারের পক্ষ থেকে চাষাড়া হীরা মহলে বাদ আছর ‘প্রয়াত একেএম শামসুজ্জোহা ও প্রয়াত বেগম নাগিনা জোহা’র রুহের মাগফেরাত কামনায় মিলাদ ও দোয়ার মাহফিল অনুষ্ঠিত হয়।

মরহুম শামসুজ্জোহার নাতি ও এমপি শামীম ওসমানের ছেলে ইমতিনান ওসমান অয়ন  নারায়ণগঞ্জকে বলেন, আমার জন্মের ঠিক ১বছর আগে আমার দাদা মারা যায়। আমার চাচাতো জেঠাতো ভাই বোন যারা আছে অধিকাংশই আমার দাদাকে দেখার সৌভাগ্য হয়েছে, কিন্তু আমার হয়নি। উনার কাহিনী শুনেই বড় হয়েছি। দাদুর যেই ত্যাগ তিতিক্ষা ছিলো, দেশের প্রতি যে ভালোবাসা ছিলো, সেভাবেই নিজেকে গড়ে তোলার চেষ্টা করি। কতটুকু পারি জানিনা, তবে মানুষের পাশে থাকার চেষ্টা করি। আমরা যথনই পরিবারের ভাইবোন সবাই একসাথে হইতাম, তখন আমার দাদি গল্প করতো আমাদের সাথে। আমরা দাদি সব সময় বলতো ‘অয়নের সাথে হুবহু মিল আছে ওর দাদার’। মাঝে মাঝে আমার কথায় বা আমার চাল চলন দেখে আমার দাদি আমাকে বলতো ‘দেখো পুরো জ্জোহা সাহেবের মতো করছে’। দাদার ব্যাপারে যখনই কোন গল্প শুনি তখই আবেগে আপ্লুত হয়ে যাই। দাদা যদি থাকতো, তাহলে হয়তো এখন কাজ গুলো বা সামনে এগুতে আরও সহজ হয়ে যেতো।

তিনি বলেন, এখন দেখি আমার বাবার সাথে আমার ছেলে যে সম্পর্ক, দেখে আলহামদুলিল্লাহ বলি আবার মাঝে মাঝে হিংসেও হয়। কারণ এই আদরটা আমি পাইনি।

অয়ন বলেন, আমরা যখন ছিলাম না, তখনও আমার দাদার মৃত্যুবার্ষিকী এলাকাবাসী করে আসছে, পালন করেছে। যারা আমার দাদার সাথে রাজনীতি করতো আমার দাদাকে ভালোবাসতো তারাই মূলত মৃত্যুবার্ষিকী পালন করতো। বিএনপি সরকার যখন ক্ষমতায় এসেছিলো তারা তখন বাধা দেয়, তবুও আমার দাদাকে যারা ভালোবাসতো তারা ঠিক এই কর্মসূচি পালন করতো। 

মতামত দিন

বিজ্ঞপ্তি
সবার আগে সব খবর পেতে ভিজিট করুন - voiceofnarayanganj.com I যে কোন সংবাদ বা বিজ্ঞাপনের জন্য যোগাযোগ করুন - 01963958226 / 01819136738 অথবা মেইল করুন - [email protected]